দেবীপক্ষ 🙏🏻
ছেলে বিদেশে সেটল্ড..ঝামেলাহীন জীবন ভালোই কাটে..রায় দম্পতির..তার ওপর উপরি পাওনা..পন্চমীতে ছেলে বৌমা আসছে দাদুভাইকে নিয়ে...এহেন এক সুখ সকালে...বীরেন্দ্রবাবুর শারদীয় ডাকে ঘুম ভাঙল.. অনিমাদেবীর..বিছানার পাশে রাখা টেবিলের চা এ চোখ গেল..সব্বনাশ..এত সুন্দর গলা শুনে স্বপ্ন দেখছেন না কি ভাবলেন..দেখলেন সবটাই সত্যি..দিলীপ বাবু বললেন- " কী গীন্নী..অবাক না কি?"
"এ কী দেবীপখখের সূচনা??" অনিমা দেবী বিস্মিত...
অনিলবাবু- "তা গিন্নী..সুখ কি শুধু বীরেন্দ্রবাবুই দেবে..আমিও নয় দিলাম..আর দেবীপখখো তো..বছর তিরিশ আগেই শুরু হয়েছিল..আমার জীবনে.. তাই আজ একটু চায়ের কাপে.. শুভ শারদীয়া... জানালাম"
কানে "জাগো দুর্গা" ডাকটা বড় মিষ্টি লাগল...
ভালোবাসা বুড়ো হয়না❤️
-------------------------------------------------
শনিবার ,সামনে পুজোর ছুটি, কাজের চাপ কম..অফিসের জানলা ঘেসে দাঁড়ালো আলাপ..কাঁচ ঢাকা জানলার পর্দা ঠেলে জ্যামিতিক আকারের আশ্বিনী রোদের টুকরো এসে পড়ছে টাইলস এর মেঝেতে...স্যুট বুট টাই এ নিজেকে বেমানান লাগে আলাপের..মনটা আজও কর্পোরেট হতে পারলনা...শব্দটা হঠাতি পুরনো কথা মনে করালো..সেদিনও ছিল এক প্রাক পুজোর মেঘলা বিকেল, গঙ্গার পাড়ে ময়ুরী বলেছিল-কর্পোরেট হ..তোর এইসব ভ্যাদা কবিতা নিয়ে থাকলে ঐ সারাজীবন মিলিনিয়ম পার্কে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গার্ডের বাঁশিই শুনতে হবে..তারপর অপেক্ষা করেনি ময়ুরী..কিন্তু জীবনের ধাক্কা কর্পোরেট করেছে আলাপকে..আজকের রোদ্দুরটা জয়ের রোদ..এক চিলতে হাসি আলাপের ঠোঁটে..কাল, এই দেবীপক্ষেই আলাপের প্রথম উপন্যাস, কলকাতার এক বড়োসড়ো পাব্লিশিং হাউস থেকে প্রকাশ পাবে..পুরনো খাতার লেখা দেখে বৌ এর আবদারেই আবার লিখতে বসে আলাপ। প্রথম উতসর্গের পাতায় লেখা.. "আমার প্রিয় প্রাক্তন কে"
এটাও বৌ এর আবদারেই..☺️
--------------------------------------------------
কুমোরটুলি পার্ক,জায়েন্ট হুইলটা সবে স্টার্ট নিয়েছে..গহন চোখ বুজে নিয়েছে.. "তোর সাথে কোনোদিন বেরোবোনা..এভাবে কেউ ভয় দেখায়,বললাম একা যা..আমি ভয়..."
কিছুতেই যখন হয়নি..অগত্যা চোখ বুজেছে গহন..
পাশে বসে উদিতা গেয়ে চলেছে.. "সূর্য ডোবার পালা..আসে যদি..."..অস্তমিত লাল সূর্যটাকে দেখলে এটাই গায় ও...
সেদিনও গাইছিল..আজও গাইছে...চোখ মেলল গহন..আজ দুজনেই মাটিতে.. জায়েন্ট হুইলে ওদের একমাত্র মেয়ে উশ্মিল... ডেকেই চলেছে.. "পা......পা...."
উদিতা..গহনের দিকে তাকিয়ে বলল.. "দেখ ভীতুরাম..মেয়েটা তাহলে তোর মত হলনা..কী বল..?"
মৃদু হাসল গহন..😊
তৃপ্ত...☺️ আফটারঅল ইটস দেবিপক্ষ।।
--------------------------------------------------------------
সুগার, প্রেশার, ডাক্তার, বদ্যি মিলে হালদারবাবুর আটোসাটো অবস্থা..তাই রবিযাপনও হয়না ঠিকঠাক... লাউ, পেপে এসে চিকেন মটন কে প্রায় রিটায়ার্ড ঘোষিত করেছে..ব্রেকফাস্ট দেখেও মনে আসেনা...আজ সানডে না মনডে..
তবু আজ টেবিল দেখে মহা খুশী হালদারবাবু.ঘুগনীর বাটির পাশে রাখা ফুলকো লুচিগুলো যেন..তার জন্যেই গান গাইছে... "পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া...ডরতা হ্যায় দিল"
সবে নায়িকার হাত ধরতে যাবে...অর্ধাঙ্গিনী এসে ব্যাঘাত ঘটালেন..."এত হেসে হেসে কার স্বপ্ন দেখছেন শুনি...?এই বয়েসে ছেলে মেয়ে সামলে সতীন সামলাতে পারবনা এই বলে দিলাম...টেবিলে স্টু রেখেছি..ব্রেকফাস্টটা করে নেওয়া হোক..."
হালদারবাবু নির্বাক...
ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলো, শশশ!! দেবিপক্ষ চলছে।।
-------------------------------------------------------------
শ্বশুরবাড়িতে আজ প্রথম ইলিশ রান্নার দিন রিন্টির...
বাড়িতে যারা কুটোটা নাড়েনা..তাদের কাছে এ দিনটা একরকম অগ্নিপরীখখাই বটে...
সবাইকে পরিবেশনের পর..সবার দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল রিন্টি..ঠিক যেমন মাধ্যমিকের রেজাল্ট এর সময় ওয়েবসাইটে বাফারিং এর দিকে চেয়েছিল...
সবাইকে বেশ তৃপ্ত লাগল..
শ্বশুর বলল- "উফফ্ অমৃত"
শাশুরি হেসে বলল- "তবে আমার ছুটি...কি বলো...?"
রিন্টি খুশি হলেও..চোখের কোণে জল এল..বাড়িতে প্রথম ইলিশ রান্না মনে পড়ে গেল..মা বাবাকে তৃপ্তি করে খেতে দেখে যখন নিজে মুখে তুলেছিল...একটুও ভাত খেতে পারেনি..বাবা নিজে ডিম ভেজে এনে ভাত খাইয়ে দিয়েছিল...চোখের জল মুছিয়ে বলেছিল... "একদিন ঠিক শিখে যাবি..."
আর দেবিপক্ষে যে ওদের পাশ করতেই হয়।।
-----------------------------------------------------------------
সকালবেলা জানলা খুলতেই
ঝেপে বৃষ্টি এল..
রাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল জানলায়..
অয়ন অফিস ট্যুরে দিল্লিতে।
ব্রেকআপের এক বছরের মাথায় অয়নের সাথে বিয়ে হয়ে যায় ওর।তবু ভোলা হয়নি পুরোনো সব কথা
এইরকম অবেলায় বৃষ্টিতে কাছের মানুষটাকে খুব মিস্ করত রাই..
আগে বৃষ্টি এলে রাই তাকে মেসেজ করত..
রাই- "একটা সেলফি পাঠা না রে...
সে- "কী সব আবদার! পারবনা এখন.."
রাই- 😞
এসব হঠাত্ মনে পড়ল..এখন আর রাই ছেলেমানুষ না.তবু পুরনো কথাগুলো মন ভারী করছিল...
হঠাতি ফোনটা ভাইব্রেট করল..হাতে তুলতেই whatsapp এ অনেকগুলো ইমেজ দেখতে পেল রাই..
সেলফি...
অয়নের...
দিল্লির রাস্তা..ওখানেও খুব বৃষ্টি...
রাই -😍😊
অয়ন- "তুমিও পাঠাও..দেখতে ইচ্ছে করছে!"☺️
বাইরে বৃষ্টিটা বোধহয় আরো বাড়ল।।
কারণ; ওদের আরেকটু বেশি খুশি হতে দিতে হয় এই দেবিপক্ষে।।
---------------------------------------------------------------
বাবা চলে যাওয়ার পর, দুই ভাই এর মায়ের দায়িত্ব এসে পড়ে একলা অঞ্জনার ওপর। কর্পোরেট আপিসের ল্যাডারে একদম বেমানান হলেও, বাড়ির কথা ভেবে মুখ বুজে অফিসের রাজনীতি, কুটকাচালি সবটা মুখ বুজে মেনে নেয়। হাঁটুর ওপরে স্কার্ট পড়া কত মেয়ে ওর পরে জয়েন করে কত বার প্রমোশন পেয়ে গেল, কিন্তু ওর কুরতির ফাক দিয়ে না ওর ক্লিভেজ বেরিয়ে আসে, না কোনো প্রমোশন লেটার ভেতরে যেতে পারে। তবু গত পরশু বসের কুপ্রস্তাবে শিউলি ফুলের মত শান্ত অঞ্জনাও ত্রিশূল ধারণ করে, পুলিশে ডাইরি লিখিয়ে অফিসের মেইলে রেজিগনেশন পাঠিয়ে দেয়। ছোট থেকেই রান্নার হাত খুব ভালো ওর, বাবা ও বলত। তাই এই দেবীপক্ষেই ছোট করে হোম ডেলিভারির ব্যবসা টা শুরু করে দেবে ঠিক করে অঞ্জনা। সংসার ঠিক চলে যাবে।। মা দুগ্গা আছেন তো।।
---------------------------------------------------------------
অহনার বয়েস বেয়াল্লিশ ছুঁই ছুঁই, পাঁচ বছর হলো ডিভোর্সি, ভালো চাকরি করে, তাই ওর আর ওর বছর পনেরোর মেয়ের দিব্যি চলে যায়। সোশ্যাল সাইটে বছর দুয়েক আগে আলাপ বছর তেইসের দ্বীপের সাথে, বন্ধুত্ব প্রেম আর তার হাত ধরে শারীরিক সম্পর্কের ফাক গোলে আজ পাঁচ সপ্তাহ হলো অহনার শরীরে দানা বেঁধেছে নতুন প্রাণ, দ্বীপ মেনে নিতে রাজি হলেও, বাঁধ সাধছে সমাজ, বাঁধ সাধছে ওর বছর পনেরোর মেয়ে। তবু অহনা এই নতুন প্রানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায়, কারণ মেয়েরা পারে, সব কিছুর শেষেও ওরা দেবী। শরীরের পরেও ওদের একটা মন আছে।।
----------------------------------------------------------------
একের পর এক কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ
হতে হতে আকাশ খুবই ভেঙে পড়ে। বাবার প্রেসার, মায়ের ওষুধ, বোনের বিয়ে, সব মিলিয়ে প্রায় নাজেহাল অবস্থা, এরম ই একদিন এলোমেলো ভাবে বেরিয়ে পড়ে আকাশ, আর কোনদিন ফিরবেনা এরম ভেবে। অজানা একটা বাসে উঠে বসে, কিছুক্ষন পর ওর পাশে এসে বসে একটা মেয়ে, ওর নাম নন্দিতা। বিমর্ষ চোখ, এলোমেলো চুল উড়ছে অকারণে, মুখে একটা বিজয়া দশমীর প্যান্ডেলের চেয়ে ও বেশি অন্ধকার। কিছু না ভেবেই আকাশ ওকে জানলার পাশের সিটটা ছেড়ে দেয়। মেয়েটা অল্প হাসে, যেন বছর কুড়ি পর হাসলো সে। জানলার সিট যে ছেড়ে দিতে পারে, তার ওপর অগাধ অমলিন বিস্বাসেই জল চেয়ে বসে নন্দিতা, তারপর দুজনে নেমে পরে বাস থেকে, গঙ্গার পাশের এক চায়ের ঠেকে নন্দিতার গল্প শোনে আকাশ- মা বাবা হারানো মামা মামীর সংসারে বোঝা হয়ে যাওয়া একটা মেয়ে যাকে রোজ পাত্রপক্ষ কোনো না কোনো কারণে প্রত্যাখ্যান করে যায়, তাই মামা মামীর খোটায় গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে এসেও আজ আটকে গেল ও, ওই শুধু একটা জানলার পাশের সিটে বসেই।
না তারপর ওরা ফোন নাম্বার এক্সচেঞ্জ করেনি কিন্তু বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল দুজনই।
------------------------------------------------------------------
তাই বলছি কি, এই দেবিপক্ষে আর কয়েকবার জানলার সিট টা ছেড়েই দেখুন না, হয়তো একজনের সারাদিনে ওইটুকুই ভাল দিতে পারেন শুধু আপনি।।
পরের জেনারেশন মায়ের রান্নার স্বাদ বুঝবেনা, মায়ের সারাদিনের ছায়া পাবেনা, এরোমটা না ভেবে একটু ভাবুন না পরের জেনারেশন হয়তো মার থেকে প্লেন চালাতে শিখবে, যুদ্ধ করতে শিখবে, সমকামিতা আলোচনা করতে শিখবে, রজঃস্বলা হয়েও বীরদর্পে প্রার্থনা করতে শিখবে, শিখবে সংসার টা মা বাবা মিলে করে, রান্নাটা দুজন মিলে করে, স্ট্রাগল টা দুজনে করে, মা সেলফি তোলে, সাজে, শেষ পাতে খায়না, মায়ের ও শখ আলহাদ হয়, বড় হয়ে মায়ের মতো ও হওয়া যায়।। একটু ভাবুন, দেবিপক্ষ তো আপনার রোজই চলে। আপনি মানতে চাননা তাই।।
Comments
Post a Comment