আপ্লিতা
ঘড়িতে ঠিক সোয়া পাঁচটা। এত সকালে ওঠার অভ্যেস টা এখন আর নেই পল্লবির, একসময় ছিল।আজ আবার সেই গন্ধ ওর ঘরে, জুই ফুল, আর ধূপের ধোয়া মেশা। আজ পঁচিশে বৈশাখ, প্রাণের ঠাকুরের জন্মদিন। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় পল্লবি, বৈশাখী সূর্য কদিন হলো ৪০ ছুঁয়েছে, জোরালো আলো এসে পড়লো ওর মুখে, চোখ বুজে এলো ওর। বাড়ির গলি দিয়ে একটা প্রভাতফেরি এগিয়ে যাচ্ছে আগুনের পরশমণি গাইতে গাইতে, ধীর পায়ে ঘরে এলো পল্লবি, বালিশের নিচের গীতবিতান টা বের করল আলতো করে, ৭৪ নম্বর পাতায় লুকোনো চিঠিটায় হাত রাখতেই, এলার্ম বেজে উঠল ফোনে। চোয়াল শক্ত করলো পল্লবি। জুঁইয়ের গন্ধ ছাপিয়ে নাকে এলো কোর্ট চত্বরের চায়ের গন্ধ, তেতো একটা গন্ধ। যার থেকে আজ রেহাই পাবে পল্লবি। মন শক্ত করলো পল্লবি, আজ পঁচিশে বৈশাখ না, আজ ৯ই মে, আজ কোর্টের ফাইনাল হিয়ারিং হয়ে যাবে,পাঁচ বছরের দাম্পত্য থেকে আইনত মুক্তি পাবে সে। উপরি পাওনা মেয়ে আপ্লিতার ওপর সম্পূর্ণ অধিকার, সবকিছু প্রায় ফাইনাল।
কিন্তু জুঁইয়ের গন্ধটা যেন পিছুই ছাড়ছেনা আজ।মা এসে দাঁড়ায় পাশে, বলে- " আজ তো একটা গান গাইতেই পারিস, পলি, আজ থেকে আপ্লিতা তো তোর। তোর ছোটবেলার সেই প্রিয় ভোর, আজ প্রায় দু বছর কোনো গান গাসনি তুই, অন্তত একবার ওই গানটা.."
হাতের ইশারায় মা কে থামায় পল্লবি।
ঘড়িতে ঠিক ভোর সোয়া পাঁচটা, পল্লবি কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, প্রথমবার কলেজের রবীন্দ্র জয়ন্তি তে, উদ্বোধনী গাইবে পল্লবি, ভোররাতের অঝোর বৃষ্টিতে প্রভাতী অনুষ্ঠান প্রায় বানচাল হওয়ার জোগাড়। আর হলো ও তাই।
ছোট থেকেই পঁচিশের এই ভোর খুব প্রিয় পল্লবির, তাই বৃষ্টি ডিঙিয়ে ভোর ঠিক ছটায় কলেজের মুক্তমঞ্চে পৌছল পল্লবি ।
ঘনঘোর বৃষ্টিতে একলা মঞ্চে মুক্ত গলায় গেয়ে চললো - "বাদল বাউল বাজায়, বাজায়, বাজায় রে" , "মন মোর মেঘের সঙ্গী", "পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে" পাগল হরিনের মতো ভিজতে ভিজতে গাইতে থাকে পল্লবি। "দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার, গাইতে গিয়ে খেয়াল পরে, আলাপের দিকে। আলাপ চক্রবর্তী। কলেজ ইউনিয়নের অন্যতম চেনা মুখ। কাক ভিজে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অপলকে চেয়ে আছে পল্লবির দিকে। গান শেষ হলে মঞ্চে উঠে আসে আলাপ। হাতে একটা সূর্যমুখী ফুলের মুকুট। পল্লবীকে পড়িয়ে দিয়ে বলে- "এরমই কোনো এক সকালে অচলায়তন ভেঙে পড়েছিল হয়তো।"
আট টা শব্দ বদলে দিলো, পল্লবির দিনযাপন।
অলক্ষে বিশ্বকবিই যেন তার সুনিপুণ রচনা শৈলিতে রচনা করলো এক নতুন গল্প। তারপর...
রিংটোনের শব্দে সম্বিৎ ফেরে পল্লবির,সাত বছরের পুরনো পঁচিশে বৈশাখ থেকে ফিরে আসে রোজকার দিন যাপনে। দিঠির ফোন, দিঠি, আপ্লিতার ডাক নাম। আলাপ আর পল্লবির একমাত্র মেয়ে। বয়েস এই তিন। মা বাবার থেকে ছমাস ছমাস ভাগ পায় আপাতত। আজ থেকে হয়তো মাকেই পাবে শুধু। এসব টানাপোড়েন এখনো পুরোটা বুঝে উঠতে পারেনি ও।
দিঠির মা ডাকে, বরফের মতো গলে গ্যালো পল্লবির সবটা। আজ দিঠির ও জন্মদিন, মার কাছে আবদার প্রিয় চকলেটের। ফোন কেটে দেওয়ার পর অনেক্ষন গীতবিতান টা ছুঁয়ে থাকলো পল্লবি।
ঘড়িতে ঠিক নটা দশ, দিঠি ভালোই ফোন করতে শিখেছে, ফোন মেয়ের হাতে দিয়ে বাথরুম এ চলে আসে আলাপ। জলের ঝাপটা দেয় চোখ মুখে, আজ সব হিসেব শেষ । একবার ও বোঝাতে পারলোনা, ওর গানের ওপারে আজ ও পল্লবিই দাঁড়িয়ে, সেই সবটুকু ভিজে। সুচরিতা শুধু ওর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা আর সহকর্মী ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। চোখ বুজে আসে আলাপের।
ঘড়িতে ঠিক নটা দশ। পঁচিশে বৈশাখ।।দিল্লিতে অফিসের ইম্পরট্যান্ট মিটিং এ ব্যস্ত আলাপ। ফোন তা সাইলেন্ট মোড এ ডাক পেরেই চলেছে। ছয় নম্বর বারে ফোনটা ধরে নেয় সুচরিতা। গলা নামিয়ে বলে, আলাপ পরে ফোন করবে। এগারোটায় ফোন করে আলাপ জানতে পারে, কলকাতার এক নার্সিং হোমে, রবিদাদুর থেকেও প্রিয় এক পুতুল পেয়েছে পল্লবি। সবচে প্রিয় উপহার পেয়েছে- "দিঠি"।। "আপ্লিতা"।। সব নাম গুছিয়েই রেখেছিল দুজনে। গুছিয়ে রাখা ছিলনা এর পরের টুকু ।
এভাবেই ওদের দুবছরের প্রেম, তিন বছরের বিবাহিত জীবনে সুক্ষ থেকে দীর্ঘতর হয় সুচরিতা নামের এক অদৃশ্য পাঁচিল। দিঠির ছোট্ট হাত দুটো, দুজনের বাড়ির লোক কেউই আটকাতে পারেনা ভাঙ্গন। পোস্ট প্রেগনেন্সি ডিপ্রেশন আর আলাপের বেড়ে যাওয়া ব্যস্ততায় বদলে যেতে থাকে মিউসিক নিয়ে হাইলি এমবিসিয়াস পল্লবি। তারপর এই ডিভোর্স নোটিস, দিঠির ভাগাভাগি, আর ভাবতে পারেনা আলাপ। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
কিছু না বুঝেও ফোন কেটে যাওয়ার পর, অঝরে কাঁদতে থাকে দিঠি। বা হয়তো বোঝে। আলাপ এসে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। আরো একবার শেষ চেষ্টা করবে ভেবে, মন শক্ত করে।
মায়ের কথা রাখতে গিয়ে প্রায় বছর দুয়েক পর "ভালোবাসি" গাইতে গিয়ে রবিঠাকুরের ছবির কাছে কেঁদে ফেলে পল্লবিও।
ঘড়িতে ঠিক এগারোটা। উকিলদের দাবি দাওয়া না মেটায় অনির্দিষ্ট কালের বন্ধ ডেকেছে তারা। কোর্ট চত্বর সুনসান। ওরা তিনজন মুখোমুখি। পল্লবি আদর করতে গ্যালে, দূরে সরে আসে দিঠি। মাথা নামিয়ে নেয় পল্লবি। আদো আদো গলায় গান গেয়ে ওঠে দিঠি.. "দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার..." ওরা দুজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এ গান তো ওরা দুজন শেখায়নি ওকে। তবে? গলা বুজে আসে দিঠির। ওরা দুজন ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। কোর্ট চত্বরে তখন শুধুই জুই ফুলের গন্ধ।।
----------------------------------
(সব চরিত্র এবং প্রেক্ষাপট কাল্পনিক, ভালোবাসার শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই ছোট্ট গল্প।)
Comments
Post a Comment