বৃষ্টি বারান্দা
পাতলা হলদে সেলফেন পেপার এর মত হলদে একটা বিকেল, আজ শহরের গায়ে লেপ্টে আছে, আকাশের ঈশান কোনে কালচে মেঘ জমে, বেশ কালো হলুদের কম্বিনেশন এর ঢাকাই জামদানিটার মতো জমাটি দেখতে লাগছে। উত্তরমুখ পাঁচতলার ব্যালকনি থেকে, গঙ্গার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে বিদীপ্তা...
সেই কৈশোরের প্রথম দিক থেকেই, এইরম বিকেল খুব পছন্দ বিদিপ্তার। অনেক কিছু মনে পড়ে যায় এইরম বিকেলে, সুজয় স্যারের কোচিন, পড়ার ফাঁকে, শুভমের চোখে চোখ রাখা মেঘলা বিকেল, সহজ সরল জিওমেট্রিও মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেত। তারপর শুভমের সাইকেল এর পাশে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই লাজুক হয়ে ওঠা, আর এরম মেঘলা এক বিকেলেই প্রথম "ভালবাসি" শুনে ফেলা। জলছবির মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে সবটা, আজ প্রায় সাতাশ বছর পর।
শুভম, এলোমেলোভাবে কপালে এসে পড়া কয়েক গোছা চুল, আর দুটো গভীর চোখ, বিদীপ্তার জীবনের প্রথম পুরুষ বলা চলে, ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, খুনসুটি, মেলায় নাগরদোলা চাপা, বাড়ির লোককে লুকিয়ে সিনেমা, বিজয়দার দোকানের ফুচকা, রাতের তারার নীচে, নৌকোর ওপর জন্মদিনের কেক কাটা, বন্ধ ঘরে দুজনের দুজনকে গভীরভাবে আবিষ্কার, ভবিষ্যতের লালচে নীলচে স্বপ্ন.... এইভাবে বছর তিনেক কেটে গেছিলো প্রায়, বিদীপ্তার বাইশ বছরের জন্মদিনে হঠাৎ ই ওর বাবার এক বন্ধুর খুব পছন্দ হয়ে যায় বিদীপ্তা কে। রঞ্জন, বাবার বন্ধুর ছেলে, তখন টাইটান এর ইস্টার্ন রিজিয়ন এর বেশ মাঝারি এক পোস্টে কর্মরত, মা বাবা এক কথায় রাজি, বিদীপ্তার হ্যাঁ, না এর কোনো গুরুত্বই ছিলনা সেদিন, আর বিদীপ্তাও ঝকঝকে নতুন প্রেমের গন্ধে বিভোর হয়ে একপ্রকার ভুলেই গেছিলো শুভমকে।
রঞ্জন, রেপুটেড ব্র্যান্ডেড সার্ট, ব্র্যান্ডেড ঘড়ি, ঝা চকচকে ব্যক্তিত্ব, দামি পারফিউম এর গন্ধে, বিদীপ্তাকে অনেকটা ভাসিয়ে নিয়ে গেছিলো, বিদীপ্তার জীবনের দ্বিতীয় পুরুষ। বছর পাঁচেক পর, ব্র্যান্ডেড স্কুলে ছেলে মেয়েকে দেওয়া নেওয়া করতে গিয়ে টের পেয়েছিল, কলেজ শেষ করাটা কতটা দরকার ছিল। রঞ্জন এর চকচকে দুনিয়া তেও ক্রমশ বেমানান হয়ে উঠেছিল বিদীপ্তা। অসময়ে ফোনের মেসেজ, খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়া, সার্টের কলারের লিপস্টিক, মাঝরাতে ওয়াসরুমে কল ছেড়ে স্ন্যাপচ্যাট এ অন্য কোন মোহময়ীর নগ্ন শরীর, বুঝিয়ে দিয়েছিল, এবার তবে সাঙ্গ হলো পালা।
সেদিন শুভমকে ভীষণ মনে পড়েছিল, তবে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুঁটি ধরে ছেলে মেয়ের মুখ চে পড়েছিল বিদীপ্তা।
আর এই ছেলের গিটার ক্লাসেই আলাপ হয়েছিল, কিংশুক এর সাথে। গিটার টিচার, লম্বা চুল, শক্ত কাঁধ, আর ঐ গিটারের স্ট্রিং-এ ওর নিখুঁত আঙুল, আর সুর শুভমকে মনে করিয়ে দিত বিদীপ্তাকে। আর এভাবেই সুরের টানে কিংশুকের কাছে এসে পড়েছিল, বিদীপ্তা। তৃতীয় পুরুষ, বছর দুয়েক ছোটই ছিল বিদীপ্তার থেকে। স্ট্রিংএর আঙুল বিদীপ্তার শরীরে সুর বুনতে শুরু করে নিভৃতে, রঞ্জনের থেকে ডিভোর্স নিয়ে নতুন শুরুর স্বপ্নে, বার তেরো বছরের না পাওয়া হঠাৎ পেয়ে গিয়ে,ভাসতে থাকে বিদীপ্তাও। রঞ্জন সব জেনে মিউচুয়াল ডিভোর্স এ ও রাজি হয়ে যায়।।
হঠাৎ ফোনের মেসেজ আসার আওয়াজ হয়, বেশ বৃষ্টি নেমেছে। ডিভোর্সের পর রঞ্জনের দেওয়া এই ফ্ল্যাট এ একলাই থাকে বিদীপ্তা। বারান্দা থেকে সরে এসে ফোনের দিকে চোখ রাখে, রঞ্জনের মেসেজ- "how are you doing?? All good with kingshuk? ..." ফোন রেখে, আবার বৃষ্টি বারান্দায় এসে দাঁড়ায় বিদীপ্তা। আজ প্রায় একসপ্তাহ হয়ে গ্যালো ওর ডিভোর্সের, ডুইং গুড হওয়ারই তো কথা ছিল।
সেদিন কোর্ট থেকে সোজা কিংশুকের ফ্ল্যাটেই গেছিলো, বিদীপ্তা। দরজার ওপার থেকে গিটারের আওয়াজ আসছিল। আনন্দে আত্মহারা বিদীপ্তা সবসময়ের মত দরজা নক না করেই ভেতরে এসছিল। আর সেই চোখ জ্বালানো দৃশ্য, গিটারের স্ট্রিং আর নগ্ন বিদীপ্তার জীবনের তৃতীয় পুরুষের মাঝে লেপ্টে আছে, অন্য এক নগ্ন নারী শরীর, গা গুলিয়ে এসছিল বিদীপ্তার।। শুভম কে মনে পড়েছিল সেদিন আবার।।
বৃষ্টির শব্দ বাড়ে, সাথে গভীরতাও। নদীর বুকের খাজে, বৃষ্টির পৌরুষত্ব গর্জন করে ওঠে। রিংটোন বেজে ওঠে, বিদীপ্তার ফোনে। পিছিয়ে এসে ফোনটা ধরে বিদীপ্তা।
ওপাশ থেকে ভেসে আসে- "কি রে বিচ্ছিরি, সরি!! বিদীপ্তা, কেমন আছিস?? আমি শুভম বলছি রে, শুনতে পাচ্ছিস???..................."
ওপাশ থেকে ভেসে আসে- "কি রে বিচ্ছিরি, সরি!! বিদীপ্তা, কেমন আছিস?? আমি শুভম বলছি রে, শুনতে পাচ্ছিস???..................."
Comments
Post a Comment